আমর ইবন আল-আস-এর অধীনে মিশরের প্রশাসন: প্রারম্ভিক ইসলামি শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর
ইতিহাসরাজনীতি, সরকার এবং প্রশাসনবিশেষ প্রবন্ধ
আমর ইবন আল-আস-এর অধীনে মিশরের প্রশাসন প্রারম্ভিক ইসলামি শাসনের এক ভিত্তিনির্মাণকাল—যেখানে রাজস্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্থানীয় বহুধা জনগোষ্ঠীর প্রতি সুস্পষ্ট নীতির রূপায়ণ লক্ষ্য করা যায়। ইবন ‘আবদুল-হাকাম-এর ফুতূহ মিসর ওয়াল-মাগরিব (Futuh Misr wa al-Maghrib)–এর আলোকে এই বিশদ একাডেমিক পর্যালোচনায় বিশেষত খলিফা উমর ইবনুল খত্তাবের যুগে আমরের আমলকে বহুস্তরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বিজয়ের প্রেক্ষাপট ও প্রাথমিক প্রশাসনিক কাঠামো
খলিফা উমর ইবনুল খত্তাব আমর ইবন আল-আসকে চার হাজার সৈন্যসহ মিশর বিজয়ের দায়িত্ব দেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ অভিযান চলে; বড় যুদ্ধকৌশল ও অবরোধ (যেমন—বাবিলিয়ন দুর্গ অবরোধ) সংঘটিত হয়, যা শেষমেশ আল-জুবাইর ইবনুল আওয়ামের মতো সাহাবিদের প্রচেষ্টায় ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। স্থানীয় কপ্টিক(Coptic) জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাথমিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; বর্ণনায় আছে—কপ্টিক বিশপ আবু বেঞ্জামিন তাঁর জনগণকে আমরের সঙ্গে সহযোগিতার পরামর্শ দেন—কারণ রোমান আধিপত্যের অবসান ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তন তিনি অনুধাবন করেছিলেন।
প্রাথমিক বিজয়ের পর আমর একটি অস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করান। মুকাওকিসের সঙ্গে এক চুক্তি হয়—প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক কপ্ট পুরুষের কাছ থেকে দুই দিনার জিজিয়া (ব্যক্তিগত কর) ধার্য হবে। তবে রোমান সম্রাট এটি প্রত্যাখ্যান করায় আবার সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। কৌশলগত শহর আলেকজান্দ্রিয়া শক্তি প্রয়োগে (‘আনাওয়াতান, অর্থাৎ বলপ্রয়োগে) দখল হয়। ফলে সেখানে ভূমিকর (খরাজ) ও জিজিয়া গভর্নরের বিবেচনায় ধার্য হয়; নির্দিষ্ট চুক্তি-হার ঠিক করা হয়নি। উল্লেখযোগ্যভাবে, আমর আলেকজান্দ্রিয়ার গনিমত সৈন্যদের মধ্যে ভাগ না করে তার আয়কে ফাই’ (রাষ্ট্রকোষে জমাকৃত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) হিসেবে নির্ধারণ করেন—যাতে ভবিষ্যৎ জিহাদ-এর জন্য সম্পদ জোগান মেলে।
করব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নীতি
আমর ইবন আল-আস মিশরজুড়ে এক করব্যবস্থা চালু করেন—ব্যক্তির ওপর জিজিয়া এবং জমির ওপর খরাজ। আলেকজান্দ্রিয়ার বাইরে, মিশরের বড় অংশে শান্তি-চুক্তির ভিত্তিতে প্রতি কপ্টিক পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট দুই দিনার জিজিয়া ধার্য ছিল। খরাজ কাঠামোয় প্রতি ফাদ্দান জমির জন্য আধা ইরদাব গম এবং দুই ওয়াইবা যব আদায়ের কথা ছিল; কিছু কৃষি অঞ্চল ছাড়প্রাপ্ত ছিল। এ ব্যবস্থায় বিদ্যমান কপ্টিক করসংগ্রহ রীতিও অনেকাংশে রাখা হয়; জনসংখ্যা ও কৃষি উৎপাদনের ওঠানামার ওপর নির্ভর করে সামঞ্জস্য করা হতো।
উমর ইবনুল খত্তাব করনীতিতে স্পষ্ট দিকনির্দেশ দেন। তিনি বলেন—জিজিয়া ব্যক্তিনির্ভর কর; আর যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের ভূমির মালিকানা অক্ষুণ্ণ থাকবে—সেটি রাষ্ট্রকোষে বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। এর উদ্দেশ্য ছিল—নতুন মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, একইসঙ্গে অমুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে স্থিতিশীল রাজস্বধারা বজায় রাখা। তবে মিশর বিজয় পুরোপুরি বলপ্রয়োগে, না কি চুক্তি-ভিত্তিতে—এই প্রশ্ন পরবর্তী ফকিহদের মধ্যে আলোচনার বিষয় থেকেছে; যার প্রভাবে ভূমির আইনি মর্যাদা ও করের ব্যাখ্যা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন হয়েছে।
উমরের ন্যায়সংগত ও দক্ষ করসংগ্রহের তাগিদ তাঁর চিঠিপত্রে প্রতিফলিত। তিনি আমরের প্রতি আক্ষেপ করেন—মিশরের উর্বরতা সত্ত্বেও পূর্বতন আয় হচ্ছে না কেন। এক সংলাপে মুকাওকিস নিজেই মিশরের সমৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করেন—সময়মতো কর আদায়, খাল খনন/পলিমাটি পরিষ্কার, সেতু নির্মাণ ও জনগণের প্রতি মানবিক আচরণ।
অবকাঠামো উন্নয়ন
উমরের নির্দেশে আমরের যুগের এক মাইলফলক কাজ ছিল “খালিজ আমীরুল মুমিনীন” (খলিফার খাল) নির্মাণ। মদিনায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে উমর নির্দেশ দেন—নাইল থেকে কুলযুম (লাল সাগরের বন্দর) পর্যন্ত একটি খাল খনন করে মিশর থেকে হিজাজে শস্য পরিবহনের পথ খুলতে। আমর এক বছরের মধ্যে খালটি সম্পন্ন করেন—এতে জাহাজে করে মক্কা-মদিনায় খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়। প্রারম্ভিক ইসলামি প্রশাসনিক ইচ্ছাশক্তি ও প্রকৌশলসামর্থ্যের এটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যদিও পরবর্তীতে খালটি অচল হয়ে পলি/বালিতে ভরে যায়।
বসতি-গঠন ও নগর পরিকল্পনা
উমরের কৌশলগত আশঙ্কা ছিল—রাজ্যকেন্দ্র (মদিনা) ও গভর্নরের মাঝে জলরাশি থাকলে যোগাযোগ ব্যাহত হবে। তাই আমর আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রাজধানী সরিয়ে নতুন স্থানে নিয়ে আসেন—যার নাম হয় “ফুস্তাত”। “ফুস্তাত” নামটি এসেছে আমরের তাঁবু (ফুস্তাত) থেকে—বিজয়ের পর তাঁর তাঁবুটি সেখানেই ছিল; তাতে কবুতরের বাসা দেখা গেলে আমর স্থানটিকে হারাম (অভয়ারণ্য/পবিত্র অঞ্চল) ঘোষণা করেন। নতুন রাজধানীতে জমি বণ্টন হয়; বিভিন্ন কৌম/ব্যক্তিকে খিতাত (প্লট) দেওয়া হয়; আমরের বাসভবনও জামেআ মসজিদের সংলগ্নে ছিল। এমনকি আলেকজান্দ্রিয়াতেও প্রাথমিক বসতিতে লোকজন বর্শা পুঁতে জমি দখল (দাবি) করত—এ রীতিও উল্লেখ আছে।
বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক দিক
আমরের প্রত্যক্ষ আমলে বিচারব্যবস্থার বিশদ না থাকলেও—পরে মিশরে ক্বাজী নিয়োগের বিস্তৃত তালিকা থেকে একটি বিকাশমান আইনি অবকাঠামো স্পষ্ট হয়। কপ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি নীতি ছিল ইসলামি যিম্মা নীতির আলোকে সুরক্ষা প্রদান। আবু যর আল-গিফারির বর্ণনায় আছে—রাসুলুল্লাহ ﷺ কপ্টদের প্রতি সদয় হওয়ার কথা বলেছেন—তাদের প্রতি “যিম্মা ও আত্মীয়তার (রাহিম)” অধিকার রয়েছে।
আমরের এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কার ছিল—নাইলের বার্ষিক প্লাবন নিশ্চিত করতে কপ্টদের প্রাক-ইসলামি কুমারী কন্যা বলিদানের রীতি বিলোপ। আমর এ প্রথা নিষিদ্ধ করলে একবার নাইল না বাড়ায় তিনি উমরের পরামর্শ চান। উমর নাইলকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লিখে দেন—আল্লাহর নামে প্রবাহের নির্দেশ। আমর চিঠিটি নদীতে নিক্ষেপ করলে এক রাতেই নাইল ষোল কুবিত বৃদ্ধি পায়। ফলে পৌত্তলিক রীতিটি চিরতরে বন্ধ হয়; মুসলিম কর্তৃত্ব সুদৃঢ় হয় এবং জনগণের মাঝে ইসলামি বিশ্বাস আরও জোরদার হয়।
তদারকি, জবাবদিহি ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
আমরের প্রশাসন খলিফা উমরের সরাসরি ও কঠোর তত্ত্বাবধানে ছিল। রাজস্ব ছাড়াও ব্যক্তিগত আচরণে খলিফা হস্তক্ষেপ করতেন। বিখ্যাত ঘটনাটি হলো—আমরের ছেলে এক কপ্টিককে আঘাত করলে উমর আমর ও তাঁর ছেলেকে ডেকে বলেন, “কবে থেকে তোমরা মানুষকে দাস বানালে—যখন তাদের মায়েরা তাদের মুক্ত জন্ম দিয়েছে?”—পরে তিনি কপ্টিককে প্রতিশোধের সুযোগ দেন। এ ঘটনাটি প্রারম্ভিক ইসলামি শাসনে যিম্মি/অমুসলিমদের প্রতিও ন্যায় ও সমতার উপর গুরুত্বকে তুলে ধরে।
উমর গভর্নরদের ব্যক্তিগত আচরণ ও জনজীবনে প্রভাব ফেলতে পারে—এমন প্রদর্শনীও নিয়ন্ত্রণ করতেন। খারিজা ইবন হুযাফা এক উঁচু কক্ষ নির্মাণ করলে প্রতিবেশীদের গোপনীয়তা বিঘ্নিত হতে পারে—এই আশঙ্কায় তিনি সেটি ভেঙে ফেলতে বলেন। রাজধানী ফুস্তাতে সরিয়ে আনা—যাতে মদিনার সঙ্গে গভর্নরের সরাসরি যোগাযোগ বজায় থাকে—এটিও ছিল উমরের প্রশাসনিক দূরদর্শিতা।
আমর ইবন আল-আস ৪৩ হিজরিতে (৬৬৩ খ্রি.) ইন্তিকাল করেন। মিশরে তাঁর সামরিক-প্রশাসনিক আমল পরবর্তী ইসলামি শাসনের জন্য ভিত্তি রচনা করে—সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ—উভয় দিক থেকেই প্রসারমান ইসলামি খেলাফতের জন্য তা এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
ইবন ‘আবদুল-হাকাম। ফুতূহ মিসর ওয়াল-মাগরিব (PDF থেকে উদ্ধৃতি)। (মূল রচনা ৯ম শতাব্দী খ্রি.)।
