আল-আন্দালুসের উত্থান-পতন: সমাজ, সংস্কৃতি ও মরিস্কোদের ট্র্যাজেডি
আইবেরীয় উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অধীন যে অঞ্চলটি আল-আন্দালুস নামে পরিচিত, অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকের বিজয়ের পর দেশীয় উপাদান ও আগত জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে এক স্বতন্ত্র ও জটিল সমাজে পরিণত হয়। আন্দালুসীয় সমাজের বিশ্লেষণে তার বহুধা জনসংখ্যাগত গঠন, খণ্ডীকরণের যুগের সামাজিক-রাজনৈতিক গতিশীলতা, সমৃদ্ধ বৌদ্ধিক জীবন, এবং শেষ পর্যন্ত তার মুসলিম অধিবাসীদের করুণ পরিণতি—এসবই বিবেচ্য।
সমাজইতিহাসরাজনীতি, সরকার এবং প্রশাসনসংস্কৃতি
আন্দালুসীয় সমাজের ভিত্তি ও গঠন
ইসলামী বিজয়ের আগে আইবেরিয়ায় ছিল এক ভিসিগোথিক রাজত্ব, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য পরিচিত ছিল। রাজারা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজাত্য ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হলেও বাস্তবে প্রায়ই শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করতেন। জনসংখ্যার মধ্যে নির্যাতিত গোষ্ঠী, বিশেষত ইহুদিরা, উল্লেখযোগ্য ছিল; আলারিক দ্বিতীয় (৪৮৪–৫০৭ খ্রি.)-এর আমল থেকে শুরু হওয়া কঠোর ইহুদি-বিরোধী আইন এবং তৃতীয় টোলেডো কাউন্সিলের (৫৮৭ খ্রি.) জোরপূর্বক ধর্মান্তর আদেশ তাদের ওপর আরোপিত হয়। রাজা উইতিज़া (৭০২–৭১০ খ্রি.)-র সময়কালে অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রকট হয়ে ওঠে; তার সংস্কার প্রচেষ্টা অভিজাত ও ধর্মীয় নেতাদের বিরাগভাজন হয়।
বিজয়ী বাহিনীর মূল অংশ ছিল আরব ও বারবর (Berber); সদ্য ইসলামে প্রবেশের কারণে বারবরদের সংখ্যা বিশেষভাবে বেশি ছিল। বিজয়ের পর ইহুদিরা আরবদের সহায়তা করে, কিন্তু এই সহায়তাকে স্পেনকে বিশ্বাসঘাতকতা করার পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং বাস্তববাদী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।
মুসলিম শাসনে সমাজ ছিল নানা জনগোষ্ঠী ও ধর্মের এক মোজাইক। মুসলিম ক্ষমতার অধীনে বসবাসকারী দেশীয় খ্রিস্টানদের বলা হতো মোজারাব (Mozarabs)। রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন একক—বিশেষত খণ্ডিত তাইফা (Taifa) রাজ্য—গঠিত হওয়ায় জনসংখ্যাগত ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বারবার বদলেছে। পরে খ্রিস্টীয় রিকঙ্কিস্তা (Reconquista)-র পর যে মুসলমানরা খ্রিস্টান শাসিত অঞ্চলে থেকে যায়, তাদের বলা হয় মুদেখার (Mudéjars)।
তাইফা যুগের সামাজিক-রাজনৈতিক গতিশীলতা
একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হওয়া তাইফা রাজ্যগুলোর যুগ একদিকে ছিল তীব্র রাজনৈতিক অবক্ষয়ের, অন্যদিকে ছিল সাংস্কৃতিক বিলাসিতা ও সামাজিক জটিলতার। সেভিয়্যার মতো শহরে আবু আল-কাসিম মুহাম্মদ ইবন আব্বাদের মতো শাসকেরা স্থানীয় অভিজাতদের ভরসায় রাজনৈতিক ও বিচারিক কর্তৃত্ব সংহত করেন।
এই সময় রাজদরবারগুলোয় ছিল বিস্ময়কর ঐশ্বর্য ও আড়ম্বর—বিরাট প্রাসাদ, বিলাসবহুল আসবাব, বিশাল অনুসারী-বাহিনী—যার মাধ্যমে রাজা-শাহানশাহি জাঁকজমক প্রদর্শিত হতো। সেভিয়্যার বানু আব্বাদের প্রাসাদসমূহ—আল-কাসর আল-মুবারক ও আল-জাহী—ঐশ্বর্যময় বস্তুসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন হিসেবে খ্যাত। সামাজিক জীবনও প্রায়ই রাজকীয় প্রিয়পাত্রদের প্রভাবাধীন ছিল; যেমন আল-মু‘তামিদ ইবন আব্বাদের পরম প্রিয় রুমাইকিয়্যা (Rumaykiyya)।
তবে এই রাজনৈতিক কাঠামো ছিল গভীরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। সমসাময়িক পণ্ডিত ইবন হাজম (মৃ. ১০৬৪ খ্রি.) এদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, শাসকেরা মুসলমানদের কাছ থেকেও কর-খাজনা ও জিজিয়া (Jizya) আদায়ের মতো বিধিবিরুদ্ধ রীতি “টিকে থাকার প্রয়োজন” বলে বৈধতা দিচ্ছেন। তার কঠোর মন্তব্য ছিল—যদি ক্রুশ গ্রহণ করলে তাদের ক্ষমতা টিকে থাকে, তবে তাইফা শাসকেরা তাতেও দ্বিধা করবেন না। খ্রিস্টীয় শক্তির ওপর তাদের নির্ভরতা—যার ফলে মুসলিম বন্দিদের দাসত্বে বিক্রি ও মুসলিম দুর্গ-শহর স্বেচ্ছায় হস্তান্তর—শেষ পর্যন্ত আজানের জায়গায় ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠার পথ প্রশস্ত করে।
এই অবক্ষয়ের সাথে অনেক ফকিহ (ফুকাহা’)-র নীরব বা সক্রিয় সমর্থনও ছিল, যা সমাজজুড়ে নৈতিক-সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে বাড়িয়ে তোলে।
সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জীবন
রাজনৈতিক আলোড়ন সত্ত্বেও তাইফা যুগ সাহিত্য-শিল্প ও বিদ্যার ক্ষেত্রে ছিল এক উর্বর ভাটি। রাজদরবারগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, আলমেরিয়ায় আল-মু‘তাসিম ইবন সুমাদিহের দরবার সেভিয়্যার সমকক্ষ এক প্রাণবন্ত সাহিত্যিক পরিবেশ গড়ে তোলে; সেখানে তার মন্ত্রী আবু আল-আসবাগ আবদুল আজিজ ইবন আরকামের মতো কবি-সাহিত্যিকদের লালন করা হতো।
ইবন হাজম ছিলেন এ সমাজের এক মহীরুহ—ফকিহ, রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ, কবি, লেখক ও নীতিদর্শনচিন্তক। তার আল-ফাস্ল ফি আল-মিলাল ওয়াল-আহ্ওয়া’ ওয়ান-নিহাল ধর্ম-দর্শন ইতিহাসের এক মাইলফলক গ্রন্থ। তদুপরি, বেশ কিছু সময়ে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশ লেখকদের নির্ভয়ে মত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছিল।
বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে সিসিলির মুসলিম সমাজ—যার সাথে আল-আন্দালুসের ভূমধ্যসাগরীয় সংযোগ ছিল—ক্রমাগত অভিবাসন ও বহিঃপ্রভাবের ঢেউয়ে “স্বতন্ত্র সিসিলিয়ান চেতনা”কে ধরে রাখতে সংকটে পড়ে। ফলে ইফ্রিকিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত কবিদের সাহিত্যের পাশাপাশি এক স্থানীয় সাহিত্যধারা সহাবস্থান করে।
মরিস্কোদের পরিণতি
রিকঙ্কিস্তার(Reconquista) চূড়ান্ত পর্যায়ে আল-আন্দালুসের সমাজে ঘটে মৌলিক রূপান্তর। খ্রিস্টানধর্মে জোরপূর্বক ধর্মান্তর (তানসীর) ক্যাথলিক সম্রাটদের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়; পরে ১৬০৮–১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের—যারা নামমাত্র খ্রিস্টান হয়েছিল—মরিস্কো (Moriscos) হিসেবে গণবহিষ্কার করা হয়। ১৬০৯-এর বহিষ্কারের পর স্পেনে ইসলাম প্রকাশ্যে প্রায় বিলুপ্ত হয়; বসবাসের শর্ত হয় খ্রিস্টধর্মে আনুগত্য প্রদর্শন।
এই বহিষ্কারের ফলে বিশাল মুসলিম প্রবাস গড়ে ওঠে, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায়। মরিস্কোরা তিউনিসসহ নানা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে; তাদের বংশধররা (যেমন ইবন আশূর পরিবার) স্থানীয় সমাজে অবদান রাখে। আনালেস দে গ্রানাদা-এর মতো গ্রন্থে ১৫৮৮–১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের অস্থিরতা ও বহিষ্কারের দলিল সংরক্ষিত আছে।
আধুনিক কালে পরিচয়ের পুনরুত্থান
শতাব্দীজুড়ে দমন-পীড়নের পর বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইসলামী ঐতিহ্য ও আন্দালুসীয় পরিচয়ে নতুন আগ্রহ দেখা দেয়। ১৯৮০ সালে আলহাম্ব্রায় প্রকাশ্যে ঈদুল-ফিতরের নামাজ আদায়—এটির একটি লক্ষণীয় উদাহরণ। তদুপরি, লিবেরাসিয়োন আন্দালুসা (Liberación Andaluza)-র মতো রাজনৈতিক আন্দোলন আন্দালুসীয়দের রাজনৈতিক মুক্তি ও ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কথা তোলে, কখনো নির্বাসিত সম্প্রদায়ের প্রত্যাবর্তনের দাবিও জানায়।
উপসংহার
আন্দালুসীয় সমাজ ছিল প্রাণবন্ত কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত এক সভ্যতা। বিপুল সম্পদ ও গভীর সাংস্কৃতিক অবদানের পাশাপাশিই ছিল রাজনৈতিক খণ্ডীকরণ ও শাসকশ্রেণির নৈতিক অবক্ষয়—যার প্রতি ইবন হাজম মতো চিন্তকেরা তীব্র আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও মরিস্কোদের বহিষ্কার সত্ত্বেও ইসলামী ও আন্দালুসীয় পরিচয়ের স্থায়ী স্রোত আজও তার ইতিহাসের স্থায়ী উত্তরাধিকারের প্রমাণ বহন করে।
তথ্যসূত্র
Abdelaziz Saleh, A. (1972). The GNBTYW of Thutmosis III’s Annals and the South Arabian Gebbanitae of the Classical Writers. In B.I.F.A.O (Vol. LXXII, p. 252).
Ageron, C. R. (n.d.). Histoire de l’Algérie Contemporaine (p. 88).
Al-Maqqarī, A. (1968). Nafḥ al-Ṭīb min Ghuṣn al-Andalus al-Raṭīb (Vol. 4, p. 528).
Al-Maqrīzī, T. A. A. (n.d.). Al-Mawā‘iẓ wa al-I‘tibār fī Dhikr al-Khiṭaṭ wa al-Āthār (Vol. 1, p. 178).
Al-Qurṭubī, Ibn al-Quṭiyya (n.d.). Tārīkh Iftitāḥ al-Andalus (p. 8–9).
Altamira, R. (1949). A History of Spain (M. Lee, Trans., pp. 32–34).
Amari. (n.d.). Storia dei Musulmani di Sicilia (Vol. 2, p. 125).
Cahen, C. (n.d.). L’Islam des Origines au Début de L’Empire Ottoman (p. 10).
Chabâs, F. (n.d.). Estudios de Erudición Oriental, Homenaje a Fr. Codera (p. 175–176).
Cohn, F. (1899). Decadencia y Desparicion de los Almoravides en Espana (p. 243).
Dozy, R. (1881). Supplément aux Dictionnaires Arabes (Vol. I, p. 366).
Dozy, R. (n.d.). Histoire des Musulmans d'Espagne (Vol. III, p. 3).
Dozy, R. (n.d.). Histoire des Musulmans d'Espagne (Vol. III, p. 79).
Dozy, R. (n.d.). Recherches sur l’Histoire et Littérature d’Espagne au Moyen Age (Vol. II, p. 232–236).
Dussaud, R. (1955). La Penetration des Arabes en Syrie avant l’Islam (p. 48).
Fage, D. G. D. (n.d.). Boville, E. A. The Golden Trade of the Moors (p. 1).
Ibn al-Abbār. (n.d.). Al-Ḥulla al-Siyarā’ (Vol. 2, p. 220–221).
Ibn Ḥazm, A. M. (n.d.). In A. Asin Palacios (Ed.), Al-Andalus (Vol. 1, p. 37).
Ibn Khaldūn. (n.d.). Al-’Ibar wa Dīwān al-Mubtada’ wa al-Khabar (Vol. 6, p. 285).
Ibn Khaldūn. (n.d.). Al-Ḥulal al-Mawshiyya (p. 25–26).
Ibn al-Kardabūs. (n.d.). Al-Iktifā’ fī Akhbār al-Khulafā’ (p. 45).
Ibn Sa‘īd. (n.d.). Al-Mughrib fī Ḥulā al-Maghrib (p. 219).
Isidoro of Seville. (1970). History of Goths, Vandals, and Suevi (G. Donini & G. B. Ford Jr., Trans., pp. 34–35, 39–42).
Katz, S. (n.d.). The Jews in the Visigothic and Frankish Kingdoms of Spain and Gaul (p. 28).
Lafuente, M. (1881). Historia General de España (Vol. II, p. 404).
Lafuente, M. (1861). Historia General de España (Vol. II, p. 390).
Muḥammad ibn ‘Abd al-Raḥmān. (n.d.). Akhbār Majmū‘a (p. 6).
Muḥammad ibn ‘Udhārī. (1948). Al-Bayān al-Mughrib fī Akhbār al-Andalus wa al-Maghrib (Vol. 2, p. 2).
Muḥammad ibn ‘Udhārī. (n.d.). Al-Bayān al-Mughrib fī Akhbār al-Andalus wa al-Maghrib (Vol. 3, p. 252).
Musil, A. (1928). Northern Negd, A Topographical Itinera (p. 304 F. and 311 F.).
O’Callaghan, J. F. (1975). A History of Medieval Spain (p. 20, 27, 37, 70–71).
Pidal, R. M. (n.d.). La España del Cid (p. 289).
Shaw, R. (1906). The fall of the Visgothic power in Spain. The English Historical Review, XXI, 211.
Strabo. (n.d.). Geography (Vol. XVI, 4:4).
