প্রাচীন ও আধুনিক নিকটপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপটে ক্রীড়া ও বিনোদনের ঐতিহাসিক মাত্রা
ইতিহাসখেলাধুলা
ঐতিহাসিক অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে শারীরিক কর্মকাণ্ড, প্রতিযোগিতা ও বিনোদন মানব সভ্যতার মৌলিক উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো কখনো নিছক অবসরের উপকরণ ছিল না; বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বহুমাত্রিক কার্যকারিতা বহন করেছে। প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে—বিশেষত মিসর, মেসোপটেমিয়া এবং আরব উপদ্বীপে—এসব কর্মকাণ্ড সামরিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, অভিজাত মর্যাদার প্রকাশ এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, চিত্রভিত্তিক উপকরণ এবং পাঠ্যসূত্রসমূহের আলোকে এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্রীড়া ও শরীরচর্চার বিভিন্ন রূপ ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
I. প্রাচীন মিসরে সংগঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
মধ্য রাজত্বকাল (প্রায় ২০৫৫–১৬৫০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে প্রমাণ মেলে যে মিসরে সংগঠিত ও আনুষ্ঠানিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল, যা কেবলমাত্র শারীরিক অনুশীলনের বাইরে গিয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। কুস্তি ছিল প্রধান ক্রীড়া, যেখানে জয়ের শর্ত ছিল প্রতিপক্ষকে শরীরের তিনটি অংশ (যেমন হাত ও হাঁটু) দিয়ে ভূমি স্পর্শ করানো। এরূপ প্রতিযোগিতায় হারার ধরন—পাশে, পেটে বা পিঠে পড়া—ফলাফলে কোনো পরিবর্তন আনত না।
শক্তি প্রদর্শনের জন্য আরও কিছু প্রতিযোগিতা ছিল, যেমন আধুনিক ভারোত্তোলনের সদৃশ কার্যক্রম। এতে প্রতিযোগীকে একহাতে তিন-চতুর্থাংশ বালুভর্তি বস্তা মাথার ওপরে তুলে সোজা ধরে রাখতে হতো। একইভাবে একটি অনন্য প্রতিযোগিতা ছিল দীর্ঘলম্ফ, যেখানে ক্রীড়াবিদকে দাঁড়ানো ষাঁড়ের পিঠের ওপর দিয়ে লাফ দিতে হতো; সহখেলোয়াড়রা ষাঁড়টির শিং ও পা ধরে রাখত। এসব প্রাতিষ্ঠানিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান মিসরীয় সমাজে সুসংগঠিত শারীরিক দক্ষতার গুরুত্ব প্রতিফলিত করে।
II. শারীরিক সক্ষমতা, শিকার ও অভিজাত মর্যাদার সংযোগ
নিকটপ্রাচ্যের সমাজে শারীরিক পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতা মর্যাদা এবং টিকে থাকার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। শিকার, যা আধুনিক দৃষ্টিতে বিনোদন হিসেবে দেখা হয়, প্রাচীন সমাজে ছিল খাদ্য, পশম এবং বস্ত্র সংগ্রহের অপরিহার্য মাধ্যম, পাশাপাশি আধিপত্যের প্রকাশ ও এক প্রকার প্রতীকী যুদ্ধ।
মিসরীয় শিল্পে বীরপুরুষদের সিংহ ও জলহস্তীর মতো শক্তিশালী প্রাণীর সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সংঘর্ষ ও দক্ষতার সাংস্কৃতিক মূল্যায়নকে প্রতিফলিত করে। যদিও পরবর্তী যুগে সহিংস ভঙ্গি শিল্পে পরিহার করা হয়। ফেরাউনরাও শারীরিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন; আখেনাতেনকে রথে গতিশীল অবস্থায় চিত্রায়িত করা হয়েছে। অভিজাতদের বিনোদনের মধ্যে ছিল জলাভূমি বা পুকুরকেন্দ্রিক কার্যক্রম, যেখানে চিত্রকর্মে স্থানীয় মাছ, কুমির ও জলহস্তীর উপস্থিতি ধরা পড়ে।
আরবে উৎকৃষ্ট ঘোড়া ও উটের যত্ন ও ব্যবহার সমাজে মর্যাদা, ধনসম্পদ ও গৌরবের প্রতীক ছিল। প্রাক-ইসলামী আরবি কবিতায় ঘোড়ার সাথে শিকার ও ক্রীড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। মরুভূমিতে উট ছিল জীবিকার কেন্দ্র, যা খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও পরিবহনের অপরিহার্য উৎস হিসেবে উচ্চ মাত্রার শারীরিক সক্ষমতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দাবি করত।
III. সামরিক প্রশিক্ষণ ও অশ্বারোহী সংস্কৃতি
সামরিক প্রস্তুতি নিকটপ্রাচ্যের ক্রীড়া ও শরীরচর্চার প্রকৃতি নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মেসোপটেমিয়ায় ধনুর্বিদ্যা, ব্রোঞ্জ অস্ত্র ব্যবহার ও দ্বন্দ্বযুদ্ধ (মুবারাযা)-এর উন্নয়ন যুদ্ধকৌশলের অংশ ছিল।
সুমেরে ঘোড়া ও রথ সামরিক শক্তি এবং অভিজাত মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। সুমেরীয় শিল্পে দুই-চাকার হালকা রথ থেকে শুরু করে চার-চাকার বিলাসবহুল রথের চিত্র পাওয়া যায়। এসব প্রতীক একদিকে মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেও, অন্যদিকে জটিল সামরিক সংস্কৃতির বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে। কুরআনেও ঘোড়া, খচ্চর ও গাধাকে পরিবহন এবং অলঙ্কারের (জীনাহ) নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
IV. আধুনিক মিসরে ক্রীড়া জীবনের দলিল
উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত মিসরে খেলাধুলা পৃথক বিনোদন হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এ সময় ক্রীড়া বিষয়ক বিশেষায়িত সাময়িকী প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত পত্রিকার তালিকায় ছিল Le Sport। ১৯১০ সালের মধ্যে Le Monde Sportif ou la Saison d'Egypte et L'Egypte Sportive এবং Cairo Sports প্রচলিত হয়। Sports নামক পত্রিকা ১৯১৯ ও ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া Sporting, Le Jocky (ঘোড়দৌড়কেন্দ্রিক), Le Volant Egyptien, Athlitis, Athlitiki Ebdomos, Egypte-Sports, এবং L'Echo-Sportif শীর্ষক সাময়িকীগুলো প্রকাশিত হয়। এগুলো প্রমাণ করে যে বিংশ শতকের শুরুতে মিসরে ক্রীড়া চর্চা ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
উপসংহার
প্রাচীন ও আধুনিক নিকটপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপটে ক্রীড়া ও শারীরিক কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র বিনোদন বা অবসরের বিষয় ছিল না; বরং এগুলো সংস্কৃতির প্রাণশক্তি, সামরিক দক্ষতা এবং সামাজিক বিভাজনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। মিসরের মধ্য রাজত্বের কুস্তি প্রতিযোগিতা, আরব উপদ্বীপের ঘোড়া পালনের মর্যাদা, মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধকৌশল এবং আধুনিক মিসরের ক্রীড়া সাংবাদিকতা—সব মিলিয়ে ইতিহাসে ক্রীড়া সংস্কৃতি সামাজিক কাঠামোয় গভীরভাবে প্রোথিত ও বিবর্তিত এক ধারাবাহিকতার পরিচায়ক।
References
Hitti, P. K. (1960). History of the Arabs. London.
Luckenbill, D. D. (1927). Ancient records of Assyria and Babylonia. Chicago.
Masry, A. H. (1974). Prehistory in north-eastern Arabia. Florida.
Musil, A. (1927). The northern Hegaz. New York.
Musil, A. (1928). Northern Negd. New York.
Musil, A. (1928). Palmyrena. New York.
Musil, A. (1930). In the Arabia desert. New York.
Olmstead, A. T. (1933). A history of Assyria. Chicago.
Oppenheim, A. L. (1966). Babylonian and Assyrian historical texts. Princeton.
Saleh, A. A. (1972). The Gnbryw of Thutmosis III's annals and the South Arabian Gebbanitae of the classical writers. Bulletin de l’Institut Français d’Archéologie Orientale, 72, 187–204.
تطور الصحافة المصرية ١٧٩٨ - ١٩٨١. (n.d.).
الشرق الأدنى القديم في مصر والعراق. (n.d.).
دراسات في تاريخ العرب القديم. (n.d.).
معالم حضارات الشرق الأدني القديم. (n.d.).
