ফিলিস্তিনি পরিচয়ের বিবর্তন: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

ইতিহাসরক্তাক্ত উম্মাহরাজনীতি, সরকার এবং প্রশাসন

Abdur Sami

10/25/20221 min read

brown mosque at daytime
brown mosque at daytime
ভূমিকা: এক বিতর্কিত পরিচয়ের সংজ্ঞা

ফিলিস্তিনি পরিচয় একটি বহুমাত্রিক নির্মাণ, যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও জাতীয় উপাদানগুলো একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সংঘটিত ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এই পরিচয়ের রূপ গঠিত হয়েছে। এটি এমন একটি পরিচয় যা বঞ্চনা, প্রতিরোধ ও বিভক্তির স্থায়ী থিম ছাড়া বোঝা যায় না—যা ফিলিস্তিনি অভিজ্ঞতার মূল বৈশিষ্ট্য। এই বিশ্লেষণটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়কাল ধরে পরিচয়ের বিবর্তনকে অনুসরণ করে, দেখায় কীভাবে একটি জটিল সমাজের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা, ঔপনিবেশিকতা ও সংঘাতের বিশাল বহিরাগত চাপ, এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ভঙ্গুর কিন্তু অবিচল সংগ্রাম ফিলিস্তিনি পরিচয়কে আকার দিয়েছে। উসমানীয় যুগের সামাজিক কাঠামো থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট, ১৯৪৮ সালের নাকবা (বিপর্যয়), এবং চলমান দখলদারিত্বের ভাঙা বাস্তবতা—সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনি পরিচয় এক দৃঢ় ও অভিযোজিত শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে।

১. উসমানীয় আমল ও প্রি-ম্যান্ডেট যুগে পরিচয়ের ভিত্তি

আধুনিক ফিলিস্তিনি পরিচয়ের বিকাশ বোঝার জন্য ব্রিটিশ শাসনের আগে বিদ্যমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো অনুধাবন জরুরি। এটি "জনশূন্য ভূমি"র ঔপনিবেশিক মিথ ভাঙতে অপরিহার্য। বাস্তবে ফিলিস্তিন ছিল কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি, বণিক পরিবার ও অভিজাত রাজনৈতিক বংশের জটিল সমন্বয়।

ঐতিহাসিক বশারা দুমানির মতে, নাবলুস অঞ্চল বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল যেখানে প্রভাবশালী পরিবারগুলো দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য পরিচালনা করত। রাজনৈতিকভাবে, যেমন হুসাইনি পরিবার, উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।

১৯১৮ সালে ফিলিস্তিনে প্রায় ৭ লক্ষ আরব ও মাত্র ৬০ হাজার ইহুদি ছিল। ভূমি ক্রয়ের মাধ্যমে ইহুদি বসতি স্থাপন আরব কৃষকদের উচ্ছেদের পথ তৈরি করেছিল। ভ্লাদিমির জাবোটিনস্কির উক্তি—ফিলিস্তিন "দিতে হবে না, নিতে হবে"—আসন্ন জাতীয় সংঘাতের ইঙ্গিত বহন করে।

২. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও জাতীয় পরিচয়ের "লোহার খাঁচা"

১৯২২–১৯৪৮ সালের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট যুগ ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিচয় গঠনের এক ক্রুশিবাটি ছিল। ব্রিটিশ নীতি ও জায়োনিস্ট প্রকল্প একসাথে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিকাশকে সীমাবদ্ধ করলেও প্রতিরোধের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা তৈরি করে।

ব্যালফোর ঘোষণা (১৯১৭) ইহুদি জাতীয় গৃহের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা পরবর্তীতে ম্যান্ডেট নথিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে আরব অধিবাসীদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি ইহুদি অভিবাসন ও ভূমি দখল উৎসাহিত করা হয়।

ফলে আরব জনসংখ্যা ১০.৭ লাখে পৌঁছালেও ইহুদি সংখ্যা বেড়ে ৪.৬ লাখে দাঁড়ায়। ভূমি দখল ও রাজনৈতিক অধিকারের সংকটে আরব বিদ্রোহগুলো সংঘটিত হয়। ডেভিড বেন-গুরিয়নের ভাষায়, শেষ পর্যন্ত সীমান্ত নির্ধারণ হবে "সামরিক সংঘর্ষ" দ্বারা।

৩. ১৯৪৮ সালের নাকবা: সমাজের ভাঙন ও শরণার্থী পরিচয়ের জন্ম

১৯৪৮ সালের যুদ্ধ ফিলিস্তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে রূপান্তরমূলক ঘটনা। এটি ছিল চূড়ান্ত বঞ্চনা—যেখানে লাখো ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে পড়ে।

গোপন চুক্তি, পরিকল্পিত উচ্ছেদ এবং ইসরাইলের "Absentees’ Property Law" ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে তাদের জমি থেকে বঞ্চিত করে। একইসাথে, জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ মানচিত্র থেকে "ফিলিস্তিন" নামটি মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন।

এভাবে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা ও শরণার্থী জাতি গঠিত হয়, যা নতুন জাতীয় আন্দোলনের পথ তৈরি করে।

৪. নির্বাসনে জাতীয় আন্দোলনের পুনর্গঠন (১৯৫০–১৯৮০ দশক)

নাকবার পর প্রথাগত নেতৃত্ব ভেঙে পড়ে। নতুন প্রজন্ম ঘাসমূল পর্যায় থেকে আন্দোলন গড়ে তোলে। কায়রোর ফিলিস্তিনি ছাত্র সংঘ, ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে, পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে পিএলও প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে।

১৯৭৪ সালে আরব লীগ পিএলও-কে ফিলিস্তিনিদের "একক বৈধ প্রতিনিধি" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে জর্ডানের সাথে সংঘর্ষ ("ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর") ও লেবাননে স্থানান্তর আন্দোলনকে দুর্বল করে। পরবর্তীতে পিএলও ধাপে ধাপে সংগ্রামের কৌশল গ্রহণ করে।

৫. দখলদারিত্বের অধীনে পরিচয়: প্রতিরোধ ও ইসলামপন্থার উত্থান

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও গাজা সরাসরি ইসরাইলি দখলে আসে। দখলদারিত্বের আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক আইনকে পাশ কাটিয়ে "বিতর্কিত এলাকা" হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৮৭ সালে প্রথম ইনতিফাদা শুরু হয়—একটি গণঅভ্যুত্থান যা নারীর অংশগ্রহণও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় হামাস উদ্ভব হয়, যারা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো ফিলিস্তিনকে "ওয়াকফ" হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ফাতাহ ও পিএলও-র সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।

৬. অসলো যুগ ও দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সংকট

১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি দুই রাষ্ট্র সমাধানের আশা জাগালেও দ্রুত ভেঙে পড়ে। ভূমি দখল, বাড়িঘর ধ্বংস, ও ব্যর্থ আলোচনার কারণে দ্বিতীয় ইনতিফাদা শুরু হয়। এটি ছিল সামরিকীকৃত, যা আরও সহিংসতা ও বিভাজন তৈরি করে।

৭. সমকালীন ফিলিস্তিনি পরিচয়: বিভাজন ও বৈশ্বিক সংগ্রাম

২১শ শতকে ফিলিস্তিনি পরিচয় গভীর ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভাজনে আক্রান্ত। পশ্চিম তীরে ফাতাহ ও গাজায় হামাসের শাসন বিভক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে। বিভাজন প্রাচীর, চেকপয়েন্ট, নজরদারি প্রযুক্তি ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

তবুও নতুন বৈশ্বিক সংগ্রাম শুরু হয়েছে—বিডিএস আন্দোলন, এক-রাষ্ট্র সমাধানের তাত্ত্বিক পুনরুত্থান, এবং আন্তর্জাতিক সংহতির প্রচেষ্টা।

উপসংহার: এক দৃঢ় কিন্তু অসম্পূর্ণ পরিচয়

ফিলিস্তিনি পরিচয় সংঘাতের ভেতর গড়ে ওঠা এক জনগোষ্ঠীর গল্প। উসমানীয় যুগ থেকে শুরু করে ম্যান্ডেট যুগ, নাকবা, পিএলও-র উত্থান, দখলদারিত্ব, এবং ২১শ শতকের বিভাজন—সব পর্যায়েই ফিলিস্তিনিরা অস্তিত্বের লড়াই চালিয়েছে।

সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে কূটনীতি, এবং স্থানীয় বিদ্রোহ থেকে বৈশ্বিক আন্দোলন—সব রূপে ফিলিস্তিনি পরিচয় রয়ে গেছে জীবন্ত, অভিযোজিত ও দৃঢ়। এটি এখনও ন্যায়বিচার, স্বীকৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের এক অসমাপ্ত সংগ্রামের প্রতীক।

Related Stories