উত্তরাধিকার সংকট: প্রথম খিলাফত প্রতিষ্ঠার একটি পর্যালোচনা

ইতিহাসরাজনীতি, সরকার এবং প্রশাসন

Abdur Sami

10/25/20221 min read

brown game pieces on white surface
brown game pieces on white surface
১.০ ভূমিকা: নজিরবিহীন শূন্যতা

১১ হিজরি, ১২ রবিউল আউয়াল (৯ জুন, ৬৩২ খ্রি.)—নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর নবগঠিত মুসলিম সমাজ এক অভূতপূর্ব নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। প্রথমবারের মতো তিনি গড়ে তোলা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন হয়ে যায়, আর জীবদ্দশায় উত্তরাধিকার (সাকসেশন) নির্ধারণের কোনো স্পষ্ট পদ্ধতি স্থির ছিল না। এক বিশ্বাসে একতাবদ্ধ উম্মাহর সামনে বড় প্রশ্ন দাঁড়ায়—এখন তাদের কে নেতৃত্ব দেবে এবং রাষ্ট্রের অখণ্ডতা কীভাবে রক্ষা পাবে? নবীজির ইন্তেকালের পরের কয়েক ঘণ্টা ও দিনের সিদ্ধান্তগুলো ইসলামি রাজনীতি ও আকিদাগত ভাবধারাকে দীর্ঘমেয়াদে গড়ে দেয়। সংকট সমাধান নির্ভর করে পড়ে নেতৃত্বের বৈধতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দাবির ওপর—যেগুলো ছিল ঈমানে অগ্রাধিকার, রক্তের আত্মীয়তা এবং উম্মাহর প্রারম্ভিক সেবার ভিত্তিতে। এই দাবিগুলো তখনকার শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের ব্যক্তিত্বেই প্রতিফলিত হয়েছিল।

২.০ প্রধান ব্যক্তিত্ব ও দলসমূহ: মর্যাদা ও নেতৃত্বের দাবি

প্রারম্ভিক মুসলিম সমাজে নেতৃত্ব কোনো আনুষ্ঠানিক পদ ছিল না; ছিল নৈতিক মর্যাদা, নবীর নিকটতা, আত্মীয়তা, অটল ঈমান ও নিঃস্বার্থ সেবার স্বীকৃতি। তাই নবীজির ইন্তেকালের পর যে দাবিগুলো উঠেছিল, সেগুলো গড়ে উঠেছিল তাঁদের জীবনের সুপরিচিত অবদান ও অবস্থানের ওপর।

২.১ আবু বকর আস-সিদ্দীক (রা.)-এর দাবি

আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদা ছিল অনন্য; নবীর ঘনিষ্ঠতা ও প্রকাশ্য স্বীকৃতি তাঁর অবস্থানকে দৃঢ় করে। তাঁর দাবি ছিল না কোনো স্পষ্ট মনোনয়ন; ছিল আস্থা ও সম্মানিত নেতৃত্বের স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা।

  • উপাধি ও স্বীকৃতি: তিনি ‘আতীক’ (আগুন থেকে মুক্ত) নামে পরিচিত ছিলেন; এবং সর্বজনস্বীকৃত উপাধি ছিল ‘সিদ্দীক’ (সত্যবাদী/সত্যের সাক্ষ্যদাতা)। হজরত আলী (রা.)-এর বরাতে এসেছে—আল্লাহই তাঁর রাসূলের জবানিতে আবু বকরকে ‘সিদ্দীক’ নাম দিয়েছেন।

  • নবীর সঙ্গ: হিজরতের সময় গুহায় “দুজনের একজন”—এই মহাসম্মান কোরআন ও সাহাবিদের কাব্যে অমর। হাসান ইবন সাবিত (রা.)-এর কবিতায় এই ঘটনা ফুটে উঠেছে।

  • নবীর ভালোবাসা: প্রসিদ্ধ হাদিসে আমর ইবন আল-আস (রা.) জিজ্ঞেস করলে নবী (সা.) বলেন—“মানুষদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আয়িশা।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “পুরুষদের মধ্যে?”—উত্তর: “তার বাবা।” অর্থাৎ আবু বকর (রা.)। নবী (সা.) হাসান (রা.)-এর সেই কবিতারও প্রশংসা করেন যাতে আবু বকরের গুণগান ছিল।

  • অর্পিত দায়িত্বে আস্থা: শেষ অসুস্থতার সময় নবী (সা.) তাঁকেই ইমামতি করতে বলেন—যা ছিল বড় ধর্মীয় ও প্রতীকী দায়িত্ব।

২.২ আনসারদের অবস্থান

মদিনার আনসার—যারা নবী (সা.) ও মুহাজিরদের আশ্রয় দিয়েছিলেন—রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি গড়েছিলেন। সাকিফার বৈঠকে তাঁদের নেতা সাদ ইবন উবাদা (রা.) এই অবদানকে সামনে রেখে নেতৃত্বের দাবি তোলেন। তাঁর বক্তব্যে স্বজনেরা একবাক্যে সমর্থন জানান—তাঁদের মতে, তারা দুর্দিনে আশ্রয় ও শক্তি জুগিয়েছেন; সুতরাং নেতৃত্ব তাঁদের হাতেও থাকা উচিত।

২.৩ আলী ইবন আবি তালিব (রা.)-এর মর্যাদা

আলী (রা.) নবীর চাচাতো ভাই ও পাত্র; সাহস ও মর্যাদায় অগ্রগণ্য। খাইবার যুদ্ধে নবী (সা.) ঘোষণার পরের দিন তাঁকেই পতাকা দেন—“আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও যাকে ভালোবাসেন।” (আবু হুরায়রা, রা.)—এতে তাঁর উচ্চ মর্যাদা প্রমাণিত। তবে সাকিফার বৈঠকে তাঁর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা এই বর্ণনায় বিস্তারিত নেই।

এই তিনভিত্তিক দাবি—সোহবত, মৌলিক সেবা ও আত্মীয়তা—সব মিলিয়ে যে জায়গায় মুখোমুখি হলো, তা-ই ছিল সাকিফার বৈঠক।

৩.০ বানু সায়িদার সাকিফা: সংকটের কেন্দ্রে

নবীজির ইন্তেকালের তাৎক্ষণিক ধাক্কায় সবাই শোকে বিহ্বল। জ্যেষ্ঠ মুহাজিররা—আবু বকর ও উমর (রা.)—দাফনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এ সময় আনসাররা নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে দ্রুত উদ্যোগ নেন।

৩.১ আনসারদের উদ্যোগ

আনসাররা বানু সায়িদার সাকিফায় জড়ো হন। তাঁদের মনোনীত প্রার্থী—খাজরাজ প্রধান সাদ ইবন উবাদা (রা.)। অসুস্থ থাকলেও তাঁকে বৈঠকে আনা হয়—এতে বোঝা যায় তাঁরা দ্রুত নিজেদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব স্থির করতে চেয়েছিলেন।

৩.২ বিতর্ক ও সমঝোতার প্রস্তাব

প্রথমে আনসারদের ঐক্যমত ছিল সাদ (রা.)-কে নেতা করা। পরে মুহাজিররা এলে মতবিনিময় হয়। বিভাজন ঠেকাতে আনসারদের পক্ষ থেকে একটি সমঝোতা প্রস্তাব আসে—

“মিন্না আমীরুন ও মিঙ্কুম আমীর”—“আমাদের পক্ষ থেকে একজন আমির, তোমাদের পক্ষ থেকেও একজন আমির।”

অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাব।

৩.৩ বিভক্ত ম্যান্ডেটের প্রত্যাখ্যান

সাদ ইবন উবাদা (রা.) এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেন। তাঁর সতর্কবাণী ছিল—

“হাজা আওয়ালুল-ওহন”—“এটাই দুর্বলতার শুরু।”

অর্থাৎ দ্বৈত নেতৃত্ব উম্মাহর ঐক্য ভেঙে দেবে; নেতৃত্ব এক ও অবিভাজ্য হওয়া দরকার। পরে সাকিফার বিতর্কের পর আবু বকর (রা.)-কে বাইআত দেওয়া হয়। তবে এটিই ছিল প্রকৃত চ্যালেঞ্জগুলোর শুরু—উম্মাহকে এক করা, শাসন চালানো ও ভেতরের মতভেদ সামলানো।

৪.০ নবীন খিলাফত: একীকরণ, শাসন ও অভ্যন্তরীণ মতভেদ

আবু বকর (রা.)-এর নির্বাচন সংকট শেষ করেনি; বরং কঠিন এক অধ্যায় শুরু হয়। নবীর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা, বিদ্রোহ দমন ও জ্যেষ্ঠ সাহাবিদের মতপার্থক্য সামাল—সব একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়।

৪.১ প্রথম পদক্ষেপ: উসামা ইবন যায়েদ (রা.)-এর সৈন্যবাহিনী পাঠানো

বাইআতের একদিন পরই নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রস্তুতকৃত উত্তরাঞ্চল অভিযানে উসামা (রা.)-র নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত তিনি বহাল রাখেন। অনেকেই তখন স্থিতিশীলতার অভাবে বিলম্বের পরামর্শ দিলেও তিনি অটল থাকেন—নবীর নির্দেশ পালনে আপস নয়। এমনকি উসামার অনুমতি নিয়ে উমর (রা.)-কে মদিনায় থেকে খলিফার উপদেষ্টা হিসেবে রাখতে বলেন—এটি শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতার প্রতীকী দৃষ্টান্ত।

৪.২ কমান্ড বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত: খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ (রা.)-এর বিতর্ক

রিদ্দা যুদ্ধের এক ঘটনায় রাষ্ট্রক্ষমতা, ন্যায়বিচার ও সামরিক আচরণ নিয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়—মালিক ইবন নুওয়াইরা প্রসঙ্গ।

  1. ঘটনা: অভিযানে খালিদ (রা.) মালিককে হত্যা করেন—তার ইসলাম থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক ছিল। পরে তিনি দ্রুত মালিকের স্ত্রী উম্মে তামিমকে বিয়ে করেন—যা যুদ্ধকালে প্রচলিত সামাজিক রীতির দৃষ্টিতে অনভিপ্রেত ছিল এবং তীব্র বিতর্ক তোলে।

  2. উমর (রা.)-এর আপত্তি: মদিনায় খবর পৌঁছালে উমর (রা.) ক্ষুব্ধ হন। বলেন, “ইন্না সাইফা খালিদিন ফিহি রাহাক”—খালিদের তরবারিতে তাড়াহুড়া/অসাবধানতা আছে। তিনি অভিযোগ করেন—এক মুসলিমকে হত্যা করে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে—এ জন্য শাস্তি দাবী করেন।

  3. খলিফার রায়: আবু বকর (রা.) ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন—খালিদের ভুল ইজতিহাদ হয়েছে, কুত্সা নয়। তিনি উমর (রা.)-কে সংযত হতে বলেন।

  4. সমাধান ও মতভেদ: বন্দিদের ফিরিয়ে দেওয়া ও রক্তপণ দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়; তবে কিছু সূত্রে আছে—বন্দি ফেরত দেওয়া হলেও রক্তপণ রাষ্ট্র থেকে না-ও দেওয়া হয়েছিল।

এই ঘটনাগুলো একদিকে খলিফার নির্বাহী কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করে, অন্যদিকে দেখায়—সামরিক কার্যকারিতা (খালিদ) ও কঠোর ন্যায়বিচারের দাবি (উমর)–এর টানাপড়েন প্রারম্ভিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস্তব চ্যালেঞ্জ ছিল।

৫.০ উপসংহার: সাকিফার নজির

উত্তরাধিকার প্রশ্নটি মুসলিম সমাজ আগে কখনো ভেবে দেখেনি। সংকটের সমাধান কোনো পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নয়, বরং সাকিফা বানু সায়িদার জরুরি ও বিতর্কিত বৈঠকের মাধ্যমে হয়। এর ফল—আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে খিলাফত প্রতিষ্ঠা—শূরা বা পরামর্শের নীতির ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু বৈধতার এই ভিত্তি সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তব চ্যালেঞ্জে পড়েছিল—উসামার বাহিনী প্রেরণ, খালিদ (রা.)-এর ঘটনা ইত্যাদি। তাই সাকিফার নজির ছিল দ্বিমুখী: একদিকে পরামর্শভিত্তিক নেতৃত্বের মডেল, অন্যদিকে এমন রাজনৈতিক-নৈতিক দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত, যা পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে।

৬.০ সূত্র
  • أبو بكر الصديق أول الخلفاء الراشدين – ط الحلبي

  • أبو هريرة راوية الإسلام

Related Stories